০৩:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
ভালোবাসার অমর নিদর্শনে ১১০ বছর ধরে বগুড়ায় শুয়ে আছেন রুপজান বিবি
স্টাফ রিপোর্টার
- Update Time : ০৭:৩৪:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
- / ২৩ Time View
ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর বাণীকে যেন সার্থক করে তুলেছে বগুড়ার এক বিরল প্রেমের উপাখ্যান। প্রায় ১১০ বছর আগে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আসা এক ইংরেজ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের অমর প্রেম আজও বগুড়াবাসীর হৃদয়ে এক অমূল্য আমানত। নিজের বাঙালি স্ত্রীকে ভালোবাসার চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ তিনি কেবল একটি সমাধিই নির্মাণ করেননি, স্ত্রীর ব্যবহৃত সোনার গহনা ও হীরা-জহরতসহ তাকে সমাহিত করেছিলেন।
বগুড়া শহরের আঞ্জুমান-ই গোরস্থানের পূর্ব প্রাচীর ঘেঁষে শুয়ে আছেন সেই নারী, রূপজান বিবি। তার সেই ভালোবাসার নির্দশন, হীরা-জহরতে মোড়া কবরটি এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে, যা আজও মানুষের কাছে অমর প্রেমের এক উজ্জ্বল সাক্ষী।
ব্রিটিশ শাসনামলে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে আসেন এক খ্রিস্টান ইংরেজ যুবক। কর্মরত অবস্থায় তিনি বগুড়ার অপূর্ব সুন্দরী নারী রূপজান বিবিকে ভালোবেসে ফেলেন। প্রথম দেখাতেই প্রেম, যা ধীরে ধীরে গভীর সম্পর্কে পরিণত হয়।
তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে প্রায় ১১০ বছর আগে একজন কুমারী মুসলিম নারীর সঙ্গে একজন খ্রিস্টান ইংরেজ পুরুষের বিয়ে হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ইংরেজ বাবুর ভালোবাসার কাছে সকল সামাজিক বাধা হার মানে। দীর্ঘ দেন-দরবার এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সমাজপতিদের সম্মতিতে অবশেষে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। সেই বিয়েতে বগুড়ার নবাববাড়ীর জমিদারসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও জানা যায়।
বিয়ের পর তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটছিল। রূপজান বিবি সন্তানসম্ভবা হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বগুড়ায় ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ১৯১৫ সালের ১০ মার্চ সেখানেই বেদনাদায়ক মৃত্যু হয় রূপজান বিবির।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইংরেজ বাবু তার মরদেহ বগুড়ায় নিয়ে আসেন। শহরের আঞ্জুমান-ই গোরস্থানের পূর্বপাশে একখণ্ড জমি কিনে রূপজান বিবিকে দাফন করা হয়। স্ত্রীকে ভালোবাসার চরম নিদর্শন হিসেবে ইংরেজ স্বামী তাঁর ব্যবহৃত সোনার গহনা, হীরা-জহরত কবরে রেখে দেন এবং সে অবস্থাতেই তাঁকে সমাহিত করেন।
কেবল তা-ই নয়, তিনি রূপজানের নামে একটি দিঘিও খনন করেছিলেন। এরপর সেই স্টেশন মাস্টার ইংরেজ বাবুকে আর কখনও বগুড়াতে দেখা যায়নি। তিনি বগুড়াবাসীর কাছে স্ত্রীর স্মৃতি ও ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ এই সমাধিটি রেখে গেছেন।
রূপজান বিবির কবরটি যে মূল্যবান সম্পদে ভরা, সেই খবর একসময় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ডাকাতদল কবরের মূল্যবান অলংকার ডাকাতি করার একাধিকবার চেষ্টা করে। কিন্তু কবরটি এতটাই শক্ত কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল যে, তারা তা ভাঙতে পারেনি। ফলস্বরূপ, আজও সেই কবর অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তবে, রূপজান বিবির নামে খনন করা সেই দিঘীটি বর্তমানে আর নেই।
বগুড়া নামাজগড় আঞ্জুমান-ই গোরস্থান কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর মোঃ শফিকুল ইসলাম নয়ন এই প্রসঙ্গে বলেন, প্রায় ১১০ বছর আগের পুরোন করব এটি। রূপজান বিবির স্বামী ইংরেজ বাবু তার স্ত্রীকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, মৃত্যুর পর মূল্যবান সোনা, হীরা, জহরত কবরে রেখে দাফন করা হয়েছিল। ডাকাতরা কবরটি ভাঙার চেষ্টা করেও পারেনি, কারণ এটি খুব শক্ত কংক্রিটের তৈরি।
তিনি আরও জানান, দ্রুতই এই ঐতিহাসিক কবরটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। রূপজান বিবির এই সমাধি শত বছর ধরে এক ইংরেজ প্রেমিকের বাঙালি স্ত্রীর প্রতি অমর ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বগুড়ার বুকে ঠাঁই করে আছে।
Tag :


















