১২:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকাকে ‘বীভৎস নরক’ বানিয়েছেন নেতারা

নিয়ন মতিয়ুল
  • Update Time : ১২:৪৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
  • / ১৫৪ Time View

ভূমিকম্পের প্রবল ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছিল না মস্তিষ্ক। শরীরে ঝাঁকুনির রেষ চলছিল কয়েক ঘণ্টা ধরে। তবে এর মধ্যেই রাস্তা থেকে ভেসে এলো মিছিল-স্লোগানের গর্জন। নির্বাচনী প্রচারণার হৈচৈ। অবাক কাণ্ড!এমনিতেই আমার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক ‘অসুখ’ আছে। কোনো ‘অঘটন’ ঘটলেই দোষ চাপাই শীর্ষ নেতা বা গণমাধ্যমের ওপর। ক্ষোভে সঙ্গিনীকে বললাম, দেখ দেখ, মূর্খদের কাণ্ড দেখ!ভয়-আতঙ্ক কাটেনি এখনও। কোথায়, কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাও জানে না কেউ।এর মধ্যেই রাজপথ প্রকম্পিত করতে নেমেছে নেতাকর্মীরা। এরা কি মানুষ, না এলিয়ান?

সঙ্গিনী বলল, রাজনীতি, নেতাদের ওপর এত রাগ দেখাচ্ছ কেন?বললাম,‘মহামানব’ নেতারাই তো দশকের পর দশক ধরে ঢাকাকে বীভৎস নরকে পরিণত করেছে। হাজার হাজার টাইম বোমার ওপর বসিয়ে দিয়েছে। তাদের ওপর কি প্রেম থাকবে?টাকার নেশায় এরা নিয়মনীতিকে ভেঙে দুমড়ে দিয়েছে। রাজনীতির দাপটে কোণঠাসা রাজউককে দিয়ে এরা বিল্ডিং কোডবিহীন লাখ লাখ ভবনের অনুমোদন নিয়েছে। সরকারের এই সংস্থাটিকে এতটাই মেরুদণ্ডহীন করে করা হয়েছে যে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ১৮ কোটি মার্কিন ডলার কাজেই লাগাতে পারেনি।

ঢাকার ২১ লাখ ভবনের মধ্যে ছয় তলার ওপরে থাকা ৬ লাখ ভবন বড় ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে। বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবকিছু ভেঙে পড়তে পারে। তবে আঁতকে ওঠার মতো তথ্য দিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। তার মতে, রাজধানীর প্রায় ৯০ ভাগ পুরোনো ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। নিশ্চিতভাবেই এসব ভবন টাইম বোমা হয়ে আছে। তাছাড়া ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষায় দাঁড়াবার কোনো জায়গাও নেই। যেখানেই দাঁড়াবেন, মাথার ওপর ভবন ভেঙে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০০-১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার, আর ২৫০-৩০০ বছর পরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ফিরে আসে। ১৯৩০ সালের পর দেশে বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় এখন সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য আসার সময় হয়ে গেছে। মাস কয়েক ধরেই বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। দেশের অন্যতম সেরা কাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার মতে, বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকা ছেড়ে পালাতে হবে।যারা বেঁচে যাবে তারা বীভৎস অবস্থার মুখোমুখি হবে। আগুন, পানি, পয়োপ্রণালির তাণ্ডবে, দুর্গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসবে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজনীতিকরা বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তা বুঝতে পারেন না। সে জ্ঞান তাদের নেই। তারা আছেন দখল আর লুটপাট নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে ঢাকা যে বায়ুদূষণে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, তা নিয়ে তাদের ভাষ্য নেই। ভেজাল খাদ্যে ক্যানসারের মহামারি নিয়ে নীরব। আগের নেতারা দূরদেশ থেকে হুমকি দিচ্ছেন, বর্তমান সরকারকে দেখে নেওয়ার, গণঅভ্যুত্থানকারীদের মেরে ফেলার। অথচ তারাই দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে মেরুদণ্ডহীন বানিয়েছেন।বর্তমানে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছেন, তারাও এক সময় দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিলেন। আবার যারা জাতিকে ধার্মিক বানানোর খোয়াব দেখছেন, তারাও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঈশ্বরের গজব বলে আত্মতৃপ্তি পান। নেতাদের হাত ধরে গড়ে ওঠা বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দেশে দখল, লুটপাট, সন্ত্রাসের রমরমা ব্যবসার প্রচলন ঘটিয়েছে। ক্ষমতামুখী সংস্কৃতিই জনগণকে আইন-নিয়ন ভাঙায় উৎসাহী, আত্মঘাতি হিসেবে গড়ে তোলে।

আর গণমাধ্যম? ভূমিকম্পের ধাক্কা খেয়েও প্রেজেন্টাররা তাৎক্ষণিক জানাতে পারেন না যে, দুঃখিত এই মুহূর্তে ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। আপনারা সতর্ক থাকুন!….তারপর তো মূল খবরে ফেরা যায়! প্রেজেন্টরদের মানুষ না বানিয়ে কলেরপুতুল করে রাখে বার্তাবিভাগ। জানি না তাদের একাডেমি নলেজ কী বলে? তবে গোটা সংবাদমাধ্যম এখন ‘নিউজ ব্যবসা’য় ব্যস্ত। আর ‘ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প’ ইভেন্টে তো নিউজের বাম্পার ফলন, তুমুল বেচাবিক্রি। তাই তো এমন ইভেন্টের জন্য অনলাইন-মাল্টিমিডিয়ার অধির অপেক্ষা। ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা না থাকলে কি আর নিউজ ব্যবসা জমে?শুধু কি তাই, রাজনৈতিক ঘনঘটা, মারামারি, কাটাকাটি, সংঘাত, রক্তপাত, গণঅভ্যুত্থানেই তো নিউজ ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠা। ফলে গণমাধ্যমে হুড়মুড় করে মেগা বিনিয়োগের ঢল। বিশাল বেতনের চাকরির হাতছানি।

কে বা কারা ঢাকাকে নরক বানাচ্ছে, হাজার হাজার টাইম বোমার ওপর কারা বসিয়ে দিচ্ছে, কারা সাধারণ মানুষের জীবন তিলে তিলে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের কী দরকার? জনগণ কি সংবাদকর্মীদের এক পয়সাও বেতন দেয়!

 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

ঢাকাকে ‘বীভৎস নরক’ বানিয়েছেন নেতারা

Update Time : ১২:৪৯:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

ভূমিকম্পের প্রবল ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছিল না মস্তিষ্ক। শরীরে ঝাঁকুনির রেষ চলছিল কয়েক ঘণ্টা ধরে। তবে এর মধ্যেই রাস্তা থেকে ভেসে এলো মিছিল-স্লোগানের গর্জন। নির্বাচনী প্রচারণার হৈচৈ। অবাক কাণ্ড!এমনিতেই আমার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক ‘অসুখ’ আছে। কোনো ‘অঘটন’ ঘটলেই দোষ চাপাই শীর্ষ নেতা বা গণমাধ্যমের ওপর। ক্ষোভে সঙ্গিনীকে বললাম, দেখ দেখ, মূর্খদের কাণ্ড দেখ!ভয়-আতঙ্ক কাটেনি এখনও। কোথায়, কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাও জানে না কেউ।এর মধ্যেই রাজপথ প্রকম্পিত করতে নেমেছে নেতাকর্মীরা। এরা কি মানুষ, না এলিয়ান?

সঙ্গিনী বলল, রাজনীতি, নেতাদের ওপর এত রাগ দেখাচ্ছ কেন?বললাম,‘মহামানব’ নেতারাই তো দশকের পর দশক ধরে ঢাকাকে বীভৎস নরকে পরিণত করেছে। হাজার হাজার টাইম বোমার ওপর বসিয়ে দিয়েছে। তাদের ওপর কি প্রেম থাকবে?টাকার নেশায় এরা নিয়মনীতিকে ভেঙে দুমড়ে দিয়েছে। রাজনীতির দাপটে কোণঠাসা রাজউককে দিয়ে এরা বিল্ডিং কোডবিহীন লাখ লাখ ভবনের অনুমোদন নিয়েছে। সরকারের এই সংস্থাটিকে এতটাই মেরুদণ্ডহীন করে করা হয়েছে যে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ১৮ কোটি মার্কিন ডলার কাজেই লাগাতে পারেনি।

ঢাকার ২১ লাখ ভবনের মধ্যে ছয় তলার ওপরে থাকা ৬ লাখ ভবন বড় ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে। বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবকিছু ভেঙে পড়তে পারে। তবে আঁতকে ওঠার মতো তথ্য দিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। তার মতে, রাজধানীর প্রায় ৯০ ভাগ পুরোনো ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। নিশ্চিতভাবেই এসব ভবন টাইম বোমা হয়ে আছে। তাছাড়া ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষায় দাঁড়াবার কোনো জায়গাও নেই। যেখানেই দাঁড়াবেন, মাথার ওপর ভবন ভেঙে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০০-১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার, আর ২৫০-৩০০ বছর পরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ফিরে আসে। ১৯৩০ সালের পর দেশে বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় এখন সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য আসার সময় হয়ে গেছে। মাস কয়েক ধরেই বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। দেশের অন্যতম সেরা কাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার মতে, বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকা ছেড়ে পালাতে হবে।যারা বেঁচে যাবে তারা বীভৎস অবস্থার মুখোমুখি হবে। আগুন, পানি, পয়োপ্রণালির তাণ্ডবে, দুর্গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসবে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজনীতিকরা বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তা বুঝতে পারেন না। সে জ্ঞান তাদের নেই। তারা আছেন দখল আর লুটপাট নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে ঢাকা যে বায়ুদূষণে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, তা নিয়ে তাদের ভাষ্য নেই। ভেজাল খাদ্যে ক্যানসারের মহামারি নিয়ে নীরব। আগের নেতারা দূরদেশ থেকে হুমকি দিচ্ছেন, বর্তমান সরকারকে দেখে নেওয়ার, গণঅভ্যুত্থানকারীদের মেরে ফেলার। অথচ তারাই দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে মেরুদণ্ডহীন বানিয়েছেন।বর্তমানে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছেন, তারাও এক সময় দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিলেন। আবার যারা জাতিকে ধার্মিক বানানোর খোয়াব দেখছেন, তারাও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঈশ্বরের গজব বলে আত্মতৃপ্তি পান। নেতাদের হাত ধরে গড়ে ওঠা বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দেশে দখল, লুটপাট, সন্ত্রাসের রমরমা ব্যবসার প্রচলন ঘটিয়েছে। ক্ষমতামুখী সংস্কৃতিই জনগণকে আইন-নিয়ন ভাঙায় উৎসাহী, আত্মঘাতি হিসেবে গড়ে তোলে।

আর গণমাধ্যম? ভূমিকম্পের ধাক্কা খেয়েও প্রেজেন্টাররা তাৎক্ষণিক জানাতে পারেন না যে, দুঃখিত এই মুহূর্তে ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। আপনারা সতর্ক থাকুন!….তারপর তো মূল খবরে ফেরা যায়! প্রেজেন্টরদের মানুষ না বানিয়ে কলেরপুতুল করে রাখে বার্তাবিভাগ। জানি না তাদের একাডেমি নলেজ কী বলে? তবে গোটা সংবাদমাধ্যম এখন ‘নিউজ ব্যবসা’য় ব্যস্ত। আর ‘ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প’ ইভেন্টে তো নিউজের বাম্পার ফলন, তুমুল বেচাবিক্রি। তাই তো এমন ইভেন্টের জন্য অনলাইন-মাল্টিমিডিয়ার অধির অপেক্ষা। ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা না থাকলে কি আর নিউজ ব্যবসা জমে?শুধু কি তাই, রাজনৈতিক ঘনঘটা, মারামারি, কাটাকাটি, সংঘাত, রক্তপাত, গণঅভ্যুত্থানেই তো নিউজ ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠা। ফলে গণমাধ্যমে হুড়মুড় করে মেগা বিনিয়োগের ঢল। বিশাল বেতনের চাকরির হাতছানি।

কে বা কারা ঢাকাকে নরক বানাচ্ছে, হাজার হাজার টাইম বোমার ওপর কারা বসিয়ে দিচ্ছে, কারা সাধারণ মানুষের জীবন তিলে তিলে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের কী দরকার? জনগণ কি সংবাদকর্মীদের এক পয়সাও বেতন দেয়!