
বগুড়ার বুক চিরে বয়ে যাওয়া এককালের প্রমত্তা করতোয়া নদী, যা পণ্ড্র সভ্যতার আঁতুড়ঘর এবং একসময়কার ব্যস্ত বাণিজ্যিক পথ ছিল, আজ যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।
দখল,দূষণ আর ভরাটের অভিশাপে একদা মৃতপ্রায় এই জলধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং জেলা প্রশাসনের সম্মিলিত প্রয়াস এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় সংলগ্ন এলাকার সৌন্দর্যবর্ধন ও খনন কাজ নদীটির পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে আনার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে করতোয়া ছিল বগুড়ার ধমনী, যার তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন পুণ্ড্র সভ্যতা। এই নদীপথে পালতোলা নৌকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্য আসতো-যেতো, যা এখানকার অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করেছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের আগ্রাসী দখল, নির্বিচার দূষণ আর পলি পড়ে ভরাটের কারণে সেই খরস্রোতা করতোয়া পরিণত হয়েছিল এক শীর্ণ মরা খালে।
বগুড়া শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর দুর্দশা স্থানীয়দের মনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর হতাশার জন্ম দিয়েছিল। নদীকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনগুলো বারবার সোচ্চার হয়েছিল।
অবশেষে সেই দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। জেলা প্রশাসন ও পাউবোর নিরলস প্রচেষ্টায় ‘বগুড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় করতোয়া নদী পুনঃখনন ও ডান তীরে স্লোপ প্রটেকশন কাজ’ শীর্ষক প্রকল্পটি গত বছরের মার্চ মাসে শুরু হয়। প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পাউবো এই কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে, যা করতোয়ার শহরের অংশের চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে নদীর ডান তীরে তৈরি হয়েছে ১২ ফুট চওড়া আধুনিক ওর্য়াকওয়ে, যা রঙিন টাইলস, তিনটি ড্রেন, ১৪টি নান্দনিক ছাতা এবং আরামদায়ক বসার বেঞ্চ দিয়ে সজ্জিত। রাতেও আলোকিত রাখার জন্য এখানে ঝলমলে সৌরবিদ্যুৎ চালিত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নদীর তীর সংরক্ষণ করায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলো নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে।
শহরের মোট ২৮ কিলোমিটার নদী খনন করা হয়েছে, যার মধ্যে এসপি ব্রিজ থেকে ডিসি অফিস পর্যন্ত ৭৩০ মিটার নদীতীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পরিবর্তনের ফলে করতোয়ার তীর এখন শহরের এক নতুন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে পরিবার নিয়ে অনেকেই এখানে হাঁটতে আসেন এবং নদীর স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করেন।
নদীর এই পরিবর্তন দেখে স্থানীয়রা দারুণ খুশি। দর্শনার্থী খোরশেদ আলম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ডিসি অফিসের সামনে করতোয়া নদীর তীর দেখলে চেনাই যায় না। একসময় যেখানে দুর্গন্ধে টেকা যেত না, এখন সেখানে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে আসা যায়।কলেজ শিক্ষার্থী মিথিলাও একই মত দিয়ে বলেন, করতোয়া এখন সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। যদি পুরো শহর জুড়ে এমন উন্নয়ন হয়, তাহলে করতোয়ার তীর একটি বড় পর্যটন কেন্দ্র হবে।
এই প্রকল্পের ঠিকাদাররা,মাইনুল হাসান সুমন, হুমায়ুন কবীর এবং আব্দুর রকিব জানান, প্রথমে নদীর পাড়ে আবর্জনার স্তূপ দেখে তাঁরা হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু বগুড়ার মানুষ হিসেবে তাঁরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং সফলভাবে কাজটি সম্পন্ন করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান এটিকে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফল হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি আশা করেন, পুরো শহরজুড়ে নদীর পাড়ে হাঁটার পথ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ হলে করতোয়া সম্পূর্ণরূপে দখল ও দূষণমুক্ত হবে। একই সাথে, তিনি নদী তীরবর্তী এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
পাউবো বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক জানান,খনন ও সৌন্দর্যবর্ধন কাজের মাধ্যমে করতোয়া তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তিনি আরও আশার কথা শোনান যে, শহর অংশে মাটিডালী থেকে বনানী এলাকা পর্যন্ত ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার আরেকটি বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়ে বাস্তবায়িত হলে করতোয়া নদী সম্পূর্ণরূপে দখল ও দূষণমুক্ত হয়ে উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। নদী খননের ফলে পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা কৃষি ও মৎস্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
বগুড়ার করতোয়া নদী এখন শুধু একটি জলধারা নয়, এটি ইতিহাস,ঐতিহ্য এবং আগামীর সম্ভাবনার প্রতীক। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে করতোয়া অচিরেই তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে এবং বগুড়াকে একটি আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও পর্যটন-সমৃদ্ধ শহরে পরিণত করবে, যা নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।